ঢাকা, ২৯ জুলাই ২০২৫ – ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ গত বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) ঘোষণা করেছেন যে, ফ্রান্স আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবে। এই ঘোষণা ফ্রান্সকে জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম এবং পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যারা ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রের মর্যাদাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে কী কারণ রয়েছে? ফ্রান্স কেন এখন এই পদক্ষেপ নিচ্ছে, এবং এর পেছনের আসল উদ্দেশ্য কী?
ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি ও মানবিক সংকট
ম্যাক্রোঁ তার ঘোষণায় বলেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে ন্যায়বিচার ও স্থায়ী শান্তির প্রতি ফ্রান্সের ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি অনুসারে, আমি ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, গাজায় চলমান যুদ্ধ বন্ধ করা এবং সেখানকার বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ত্রাণ পৌঁছানো এখন সবচেয়ে জরুরি। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান এবং তিন মাসের অবরোধের ফলে সৃষ্ট মানবিক সংকট, যেখানে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে, ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের ফলে ৫৯,৫৮৭ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, এবং ত্রাণ সরবরাহে কঠোর বিধিনিষেধের কারণে সেখানে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং আরও ২১টি ইসরায়েল-সমর্থক দেশ সম্প্রতি একটি যৌথ বিবৃতিতে গাজায় ত্রাণ সরবরাহে ইসরায়েলের বিধিনিষেধ এবং খাদ্যের জন্য ফিলিস্তিনিদের হত্যার নিন্দা জানিয়েছে। এই মানবিক বিপর্যয় ফ্রান্সের সিদ্ধান্তকে ত্বরান্বিত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতি
ফ্রান্স দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান হিসেবে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে। ম্যাক্রোঁ তার বক্তব্যে বলেছেন, “এই সমাধানই ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের বৈধ আকাঙ্ক্ষা পূরণের একমাত্র পথ।” তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, হামাসের নিরস্ত্রীকরণ, গাজার পুনর্গঠন এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা এই প্রক্রিয়ার অংশ হবে। ফ্রান্সের এই পদক্ষেপ দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ধারণাকে বাঁচিয়ে রাখার একটি প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে, বিশেষ করে যখন গাজার ধ্বংসযজ্ঞ এবং পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ এই সমাধানকে ক্রমশ অসম্ভব করে তুলছে।
ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি বৃহত্তর গতিশীলতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। ম্যাক্রোঁ আশা করছেন যে, এই পদক্ষেপ অন্যান্য জি-৭ দেশ, যেমন যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং ইতালিকে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করবে। ইতোমধ্যে স্পেন, আয়ারল্যান্ড এবং নরওয়ে গত বছর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং ফ্রান্সের এই পদক্ষেপ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্র, যেমন মাল্টা এবং বেলজিয়ামের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
কূটনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিশীলতা
ফ্রান্সের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কূটনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ফ্রান্সে ইউরোপের সবচেয়ে বড় ইহুদি এবং মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে, এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত প্রায়ই দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলে। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে ফ্রান্স ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল অবস্থান গ্রহণ করেছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শার্ল দ্য গল ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলেছিলেন, এবং ফ্রান্স দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখেছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ৮০% ফরাসি নাগরিক ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে।
অভ্যন্তরীণভাবে, ম্যাক্রোঁ তার রাষ্ট্রপতির দ্বিতীয় ও শেষ মেয়াদে বিদেশ নীতির উপর জোর দিচ্ছেন। গাজার মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে নিষ্ক্রিয়তা তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের উপর কালো দাগ ফেলতে পারে। তিনি এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ফ্রান্সের নৈতিক ও আইনি অবস্থানকে জোরালো করতে চাইছেন, বিশেষ করে যখন তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একমাত্র পারমাণবিক শক্তি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ফ্রান্সের প্রভাব ব্যবহার করতে চান।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র প্রতিক্রিয়া
ফ্রান্সের এই ঘোষণা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র নিন্দার মুখে পড়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই পদক্ষেপকে “সন্ত্রাসকে পুরস্কৃত করা” এবং “ইসরায়েল ধ্বংসের জন্য একটি লঞ্চপ্যাড তৈরি” বলে অভিহিত করেছেন। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিয়ন সার বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত হামাসের জন্য একটি পুরস্কার এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।” যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এটিকে “৭ অক্টোবরের শিকারদের জন্য একটি চড়” বলে মন্তব্য করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, “ম্যাক্রোঁর এই বক্তব্যের কোনো ওজন নেই।”
ইসরায়েলের অভিযোগ, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি হামাসকে শক্তিশালী করবে এবং ইসরায়েলের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র, যিনি দীর্ঘদিন ধরে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য সরাসরি আলোচনার উপর জোর দিয়েছে, এই একতরফা পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে।
ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। পিএলও-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হুসেইন আল-শেখ বলেছেন, “এই অবস্থান ফ্রান্সের আন্তর্জাতিক আইন এবং ফিলিস্তিনিদের স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।” হামাস এটিকে “ন্যায়বিচারের দিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ” বলে অভিহিত করেছে এবং অন্যান্য দেশকে ফ্রান্সের পদাঙ্ক অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে, স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ এবং আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন হ্যারিস ফ্রান্সের এই পদক্ষেপকে “গুরুত্বপূর্ণ অবদান” হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। সৌদি আরবও এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে বলেছে, এটি ফিলিস্তিনিদের স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐকমত্যকে পুনরায় নিশ্চিত করে।
কূটনৈতিক কৌশল ও ঝুঁকি
বিশ্লেষকদের মতে, ম্যাক্রোঁর এই সিদ্ধান্ত একটি সাহসী কূটনৈতিক পদক্ষেপ, যদিও এটি মূলত প্রতীকী। ফ্রান্স এবং সৌদি আরবের সহ-আয়োজনে জুন মাসে পরিকল্পিত একটি সম্মেলন ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের কারণে স্থগিত হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় এই ঘোষণা দিয়ে ফ্রান্স অন্যান্য দেশকে ফিলিস্তিন স্বীকৃতির জন্য উৎসাহিত করার একটি কাঠামো তৈরি করতে চায়। তবে, এই পদক্ষেপ ইসরায়েলের সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ককে আরও টানাপড়েন করতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক দূরত্ব বাড়াতে পারে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই সিদ্ধান্ত ম্যাক্রোঁর ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ফ্রান্সের বিশ্ব মঞ্চে নেতৃত্বের ভূমিকা জোরদার করার ইচ্ছার প্রতিফলন। তবে, গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি বা মানবিক সংকট সমাধানে এর প্রভাব সীমিত থাকতে পারে, কারণ ইসরায়েল এখনও ফিলিস্তিনি অঞ্চল দখল করে রেখেছে।