সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশে লাখো মানুষের ঢল

ঢাকা, ১৯ জুলাই ২০২৫: রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শনিবার (১৯ জুলাই) বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আয়োজিত প্রথম জাতীয় সমাবেশে লাখো নেতাকর্মী ও সমর্থকের উপস্থিতিতে মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। দলটির ইতিহাসে এটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রথম একক সমাবেশ, যা সকাল ৯:৪০ টায় কোরআন তেলাওয়াত ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হয় এবং দুপুর ২টায় আনুষ্ঠানিকভাবে মূল সমাবেশ শুরু হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।

বিশাল জনসমাগম ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি

শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন, ও লঞ্চে করে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করেন। সকালের মধ্যেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। জামায়াতের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ও জাতীয় পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে আগত নেতাকর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় মুখরিত ছিল পুরো এলাকা। দলটির লক্ষ্য ছিল প্রায় ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটানো, যা তারা সফলভাবে অর্জন করেছে বলে দাবি করেছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা রাজনীতির মাঠে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করতে চাই।” সমাবেশে শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রায় ২০,০০০ স্বেচ্ছাসেবক নিয়োজিত ছিলেন, যার মধ্যে ৬,০০০ শুধুমাত্র সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশে দায়িত্ব পালন করেন। মাঠে ১৫টি মেডিকেল বুথ, পানির ব্যবস্থা, ওয়াশরুম, এবং জায়ান্ট স্ক্রিনের মাধ্যমে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হয়।

সাত দফা দাবি ও রাজনৈতিক বার্তা

জামায়াতে ইসলামী এই সমাবেশে সাত দফা দাবি উত্থাপন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিতকরণ।
  • জুলাই গণহত্যার বিচার।
  • প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার।
  • জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন।
  • জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন।
  • সংখ্যানুপাতিক (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচন।
  • ১ কোটির বেশি প্রবাসী ভোটারের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ।

দলটি জানিয়েছে, এই সমাবেশ শুধু জামায়াতের নয়, বরং সব দল-মত-ধর্মের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, এনসিপিসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও বিএনপির কোনো নেতার উপস্থিতি নিশ্চিত হয়নি।

১৯৭৯ সালে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে গত ৪৫ বছরে জামায়াতে ইসলামী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কখনো একক সমাবেশ করেনি। তবে বিএনপির সঙ্গে জোটে থাকাকালীন যৌথ সমাবেশে অংশ নিয়েছিল। জামায়াতের নেতারা এই সমাবেশকে ‘ইতিহাস রচনার’ টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করেছেন। দলটির নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, “আল-হামদুলিল্লাহ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পুরোপুরি প্রস্তুত। এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা আমাদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থন প্রকাশ করতে চাই।”

সমাবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ, র‍্যাব, ও ডিবি’র পাশাপাশি জামায়াতের স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করছেন। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সঙ্গে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা, পরিবহন, ও জনসাধারণের সুবিধার বিষয়ে সমন্বয় করা হয়েছে। জামায়াতের নির্দেশনায় নেতাকর্মীদের কোনো রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে স্লোগান না দেওয়া, জাতীয় পতাকা ব্যতীত অন্য পতাকা প্রদর্শন না করা, এবং বৃষ্টি হলেও অবস্থান ধরে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামী তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে এই সমাবেশের মাধ্যমে দলটি তাদের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রভাব প্রদর্শনের লক্ষ্য নিয়েছে। জামায়াতের নেতারা জানিয়েছেন, এই সমাবেশ নতুন প্রজন্মের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেবে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, যেখানে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা ঘটেছিল, সেখানে এই সমাবেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী তাদের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করল।