ঢাকা, ১৬ জুলাই ২০২৫ – আজ থেকে ৮০ বছর আগে, ১৬ জুলাই ১৯৪৫ সালে, বিশ্ব ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল যখন প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা, যা ‘ট্রিনিটি টেস্ট’ নামে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর আলামোগর্ডো মরুভূমিতে সফলভাবে সম্পন্ন হয়। ম্যানহাটন প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত এই পরীক্ষা মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তির বিধ্বংসী ক্ষমতা প্রকাশ করে। এই ঘটনা বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিস্ময়, উৎকণ্ঠা এবং নৈতিক দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়, যা আজও পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
ট্রিনিটি টেস্ট: কোথায় এবং কীভাবে?
ট্রিনিটি টেস্টটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর জর্নাডা ডেল মুয়ের্তো মরুভূমিতে অবস্থিত আলামোগর্ডো বোম্বিং রেঞ্জে সংঘটিত হয়। সকাল ৫:২৯ মিনিটে (স্থানীয় সময়) প্লুটোনিয়াম-ভিত্তিক বোমা ‘গ্যাজেট’ বিস্ফোরিত হয়, যার শক্তি ছিল প্রায় ২০ কিলোটন টিএনটি’র সমতুল্য। এই বিস্ফোরণের ফলে একটি বিশাল অগ্নিগোলক সৃষ্টি হয়, যা সূর্যের মতো উজ্জ্বল আলো ছড়ায় এবং ৪০ মাইল দূর থেকেও দৃশ্যমান ছিল। মাটিতে একটি বিশাল গর্ত সৃষ্টি হয়, এবং বালি উত্তপ্ত হয়ে কাচের মতো পদার্থে (ট্রিনিটাইট) রূপান্তরিত হয়।
ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী ড. জে. রবার্ট ওপেনহাইমারের নেতৃত্বে এই পরীক্ষায় অংশ নেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা, যার মধ্যে ছিলেন এনরিকো ফার্মি, রিচার্ড ফাইনম্যান, এবং জর্জ কিস্টিয়াকোস্কি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই পরীক্ষা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও স্থলবাহিনীর যৌথ প্রকল্প, যার লক্ষ্য ছিল নাৎসি জার্মানি এবং জাপানের বিরুদ্ধে কৌশলগত সুবিধা অর্জন।
বিজ্ঞানীদের প্রতিক্রিয়া
ট্রিনিটি টেস্টের সাফল্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ড. জে. রবার্ট ওপেনহাইমার, যিনি পরে ‘পারমাণবিক বোমার জনক’ হিসেবে পরিচিত হন, বিস্ফোরণের ভয়াবহতা দেখে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ভগবদ্গীতার একটি শ্লোক উদ্ধৃত করেন: “এখন আমি মৃত্যুতে পরিণত হয়েছি, বিশ্বের ধ্বংসকারী।” এই উক্তি তার মনে জাগা নৈতিক দ্বন্দ্ব এবং পারমাণবিক শক্তির সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।
এনরিকো ফার্মি, যিনি পারমাণবিক চুল্লির উদ্ভাবক, বিস্ফোরণের শক্তি দেখে বিস্মিত হন এবং এটিকে একটি “অসাধারণ বৈজ্ঞানিক অর্জন” হিসেবে অভিহিত করেন। তবে, তিনি পরে পারমাণবিক অস্ত্রের অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রিচার্ড ফাইনম্যান, একজন তরুণ বিজ্ঞানী, বিস্ফোরণের উজ্জ্বল আলো দেখে উৎফুল্ল হলেও পরে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব নিয়ে চিন্তিত হন। বিজ্ঞানী কেনেথ বেইনব্রিজ পরীক্ষার পর ওপেনহাইমারকে বলেন, “এখন আমরা সবাই ধ্বংসের পথে।”
অনেক বিজ্ঞানী এই পরীক্ষার সাফল্যে উৎসাহিত হলেও, তাদের মধ্যে একটি গভীর নৈতিক প্রশ্ন জাগে: এই শক্তি কি মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হবে, নাকি ধ্বংসের হাতিয়ার হয়ে উঠবে? এই প্রশ্নটি পরবর্তীতে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের পর আরও তীব্র হয়।
প্রেক্ষাপট
ট্রিনিটি টেস্ট ছিল ম্যানহাটন প্রকল্পের ক্লাইম্যাক্স, যা ১৯৪২ সালে শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনার ভয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রকল্পে বিপুল অর্থ ও জনবল বিনিয়োগ করে। ট্রিনিটি টেস্টের সাফল্যের মাত্র তিন সপ্তাহ পর, ৬ এবং ৯ আগস্ট ১৯৪৫-এ হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়, যা লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নেয় এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে।
ঐতিহাসিক তাৎপর্য
ট্রিনিটি টেস্ট পারমাণবিক যুগের সূচনা করে এবং বিশ্ব রাজনীতি ও সামরিক কৌশলকে চিরতরে বদলে দেয়। এটি বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির একটি মাইলফলক হলেও, পারমাণবিক অস্ত্রের নৈতিক এবং মানবিক প্রভাব নিয়ে আজও বিতর্ক চলছে। বর্তমানে, পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ এবং শান্তিপূর্ণ শক্তি ব্যবহারের বিষয়টি বিশ্ব নেতাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
ট্রিনিটি টেস্ট ছিল মানব ইতিহাসে একটি দ্বিমুখী ঘটনা—একদিকে বৈজ্ঞানিক বিস্ময়, অন্যদিকে ধ্বংসের আশঙ্কা। এই পরীক্ষার ৮০তম বার্ষিকীতে আমরা বিজ্ঞানের শক্তি এবং এর দায়িত্বশীল ব্যবহার নিয়ে পুনরায় চিন্তা করতে পারি। পারমাণবিক শক্তি যেন মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়, এই প্রত্যাশা নিয়ে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে।