ঢাকা, ২৭ আগস্ট ২০২৫ – বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ আগামী সপ্তাহে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিউ পিটিশনের শুনানি গ্রহণ করবে। ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিধান প্রবর্তন করেছিল, তা অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সংগঠনের দায়ের করা পুনর্বিবেচনা আবেদন এখন সর্বোচ্চ আদালতের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এই শুনানি দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ঐতিহাসিক পটভূমি
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকালীন সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা। ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই ব্যবস্থা সফলভাবে কার্যকর হয়েছিল এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক প্রশংসা অর্জন করেছিল। তবে, ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, সাত সদস্যের বেঞ্চের ৪:৩ ভোটে, এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে, যুক্তি দিয়ে যে এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো এবং গণতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রায়ে বলা হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতাকে সীমিত করে এবং সংবিধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনের নীতির পরিপন্থী। তবে, আদালত পরবর্তী দুটি নির্বাচনের (২০১৪ ও ২০১৮) জন্য এই ব্যবস্থা বহাল রাখার অনুমতি দিয়েছিল, যদিও এটি বাস্তবায়িত হয়নি।
রিভিউ পিটিশনের প্রেক্ষাপট
২০১১ সালের রায়ের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলগুলো সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, এবং ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবি জোরালো হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং নাগরিক সংগঠনগুলো এই ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য বলে মনে করে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী পৃথকভাবে ২০১১ সালের রায়ের পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল বিভাগে রিভিউ পিটিশন দায়ের করে। তারা যুক্তি দিয়েছে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এবং ২০১১ সালের রায় সংবিধানের গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর এই ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো হয়েছে।
শুনানির গুরুত্ব
আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রিভিউ শুনানি পরিচালনা করবে। শুনানির সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫। এই শুনানি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে:
-
সাংবিধানিক বৈধতা: তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
-
নিরপেক্ষ নির্বাচন: এই ব্যবস্থা ছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কিনা, বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে।
-
জনগণের আস্থা: তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে?
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ এক্স প্ল্যাটফর্মে বলেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। আমরা আশা করি সুপ্রিম কোর্ট এই রায় পুনর্বিবেচনা করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করবে।” অন্যদিকে, আইনজীবী ও সাংবিধানিক বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, “এই শুনানি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আদালতকে সংবিধানের চেতনা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।”
সম্ভাব্য প্রভাব
এই শুনানির ফলাফল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোর উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। সম্ভাব্য ফলাফলগুলো হতে পারে:
-
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন: যদি আদালত ২০১১ সালের রায় বাতিল করে, তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তিত হতে পারে, যা ২০২৬ সালের নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
-
রায় বহাল: যদি আদালত পূর্বের রায় বহাল রাখে, তবে নির্বাচনী সংস্কারের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা জোরদার হবে।
-
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: এই রায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বা বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে।
এক্স প্ল্যাটফর্মে একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সুপ্রিম কোর্টের উপর জনগণের ভরসা রয়েছে।” আরেকজন লিখেছেন, “এই শুনানি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।”