ঢাকা, ২৩ জুলাই ২০২৫, প্রথম আলো
রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা দেশের ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। গত সোমবার (২১ জুলাই) দুপুর ১:০৬ মিনিটে ঘটে যাওয়া এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে, যার মধ্যে ১৭ জন শিশু শিক্ষার্থী এবং বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর। আহত হয়েছেন ১৭১ জনেরও বেশি, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী। এই ঘটনা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ছাড়িয়ে সারা দেশে শোকের ছায়া ফেলেছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, বিমানটি ছিল এফ-৭ বিজিআই মডেলের একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান, যা উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পরেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাইলস্টোন স্কুলের হায়দার হল ভবনের ছাদে আছড়ে পড়ে। বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানে আগুন ধরে যায়, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভবনের দুটি শ্রেণিকক্ষ ও সিঁড়ি প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুর্ঘটনার সময় ভবনে প্লে গ্রুপ থেকে সপ্তম শ্রেণির ক্লাস চলছিল, এবং কিছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবক টিচার্স রুমের পাশে ল্যান্ডিং স্পেসে ছিলেন।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার লিমা খানম জানান, দুপুর ১:১৮ মিনিটে দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর উত্তরা, টঙ্গী, পল্লবী, কুর্মিটোলা, মিরপুর ও পূর্বাচল ফায়ার স্টেশন থেকে মোট নয়টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। তবে, তীব্র আগুন ও ধোঁয়ার কারণে উদ্ধার কার্যক্রমে বিলম্ব হয়।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ২৮ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই শিক্ষার্থী এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ঢাকা সিএমএইচ, উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল এবং লুবনা জেনারেল হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিহতদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি, এবং তাদের ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পর প্রচণ্ড শব্দ ও ধোঁয়ার মধ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা আতঙ্কিত হয়ে ছুটোছুটি করছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শী এক্স প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “চারপাশে শুধু আগুন আর ধোঁয়া। শিশুদের চিৎকারে হৃদয় ভেঙে যায়।” স্থানীয় বাসিন্দা ঝর্না আক্তার, যার তৃতীয় শ্রেণির ছেলে জুনায়েদ হাসান আইসিইউতে চিকিৎসাধীন, বলেন, “আমার ছেলেকে সকালে সুস্থ অবস্থায় স্কুলে পাঠিয়েছিলাম, এখন সে হাসপাতালে।”
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটনে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বিমানটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়। আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমানটি দুপুর ১:০৬ মিনিটে উড্ডয়ন করেছিল এবং মাত্র কয়েক মিনিট পরেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
এই মর্মান্তিক ঘটনায় সরকার মঙ্গলবার (২২ জুলাই) একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক শোকবার্তায় বলেন, “এই দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতি অপূরণীয়। জাতির জন্য এটি একটি গভীর বেদনার ক্ষণ। আমি আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছি।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে। একজন ব্যবহারকারী এক্সে লিখেছেন, “মাইলস্টোন স্কুলে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা কল্পনাতীত। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।” আরেকজন লিখেছেন, “শিশুদের স্কুলে এমন দুর্ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। দায়ীদের জবাবদিহি করতে হবে।”
উত্তরায় এর আগেও বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫ সালে ফায়েদাবাদে এবং ২০১৯ সালে উত্তরা মডেল টাউনে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো এলাকায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগকে আরও জোরালো করেছে।
২০০২ সালে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল নূরান নবী প্রতিষ্ঠিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, এখানে ২০,২৩৬ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এই দুর্ঘটনা প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমরা এই মর্মান্তিক ঘটনায় গভীরভাবে শোকাহত। আমাদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় শোকের কারণ। এই ঘটনা বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের নিরাপত্তা, শহুরে এলাকায় উড্ডয়নের ঝুঁকি এবং জরুরি প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এবং সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ এই ঘটনার দায় নির্ধারণ এবং ভবিষ্যৎ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। নিহতদের প্রতি সমবেদনা এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করে দেশবাসী এখন একটি নিরাপদ ও স্বচ্ছ ভবিষ্যতের আশায় প্রতীক্ষা করছে।